বোবায় ধরা বা স্লিপ প্যারালাইসিস কী? ঘুমের মধ্যে মানুষকে কেন বোবায় ধরে?

বোবায় ধরা বা স্লিপ প্যারালাইসিস

মানুষকে বোবা ধরে কেন?

‘বোবায় ধরা’, এই পরিভাষাটির সাথে একদমই পরিচয় নেই, এমন মানুষ বোধ হয় খুঁজে পাওয়া যাবে না বেশিরভাগ মানুষই মাঝরাতের ভূতুড়ে অভিজ্ঞতা বা মনঃস্তত্ত্বের জ্ঞান নিয়ে নাড়াচাড়া কিংবা লোকমুখে শোনা নানা উপকথা-কুসংস্কার থেকে বোবায় ধরা সম্পর্কে জেনে থাকে। কিন্ত আসলে মানুষকে বোবা ধরে কেন বা স্লিপ প্যারালাইসিস কেন হয়। বোবায় ধরার পেছনে প্রকৃত কারণ কী বা প্রকৃত অর্থেই কী ঘটে থাকে, এ ব্যাপারে দু’রকম ব্যাখ্যা পাওয়া যায়- একটি অতিপ্রাকৃতিক বিষয়ের প্রতি বিশ্বাস নির্ভর অধিজাগতিক ব্যাখ্যা, অন্যটি মনঃশারীরবৃত্তিক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা।


তবে যা-ই হোক, বোবায় ধরার ক্ষেত্রে ব্যক্তিভেদে অভিজ্ঞতার ধরন সবারই মোটামুটি একই রকম। বোবায় ধরা হলোঃ- ঘুম আসার কিছুক্ষণের মধ্যে হটাৎ ঘুম ভেঙে যায় এবং স্বল্প সময়ের জন্য বাকশক্তি এবং চলনশক্তি হারিয়ে যায়। ঘুম ভাঙার আগে পরে অনেকে অনেক কিছু অনুভব করেন, আবার অনেকে অনেক কিছু দেখতেও পান।


‘বোবায় ধরা’ নামের উৎপত্তি :

বাংলায় ‘বোবায় ধরা’ নামটিএসেছে মুলত লোকাচারীয় কুসংস্কার হতে। বলা হয়, "বোবা নামের ভূত ঘুমের ভেতর মুখ চেপে ধরে, তাই চোখ খুললেও মানুষ তখন কথা বলতে পারে না।" একেই ‘বোবায় ধরা’ বলে। তবে সেই ভূতটির নাম কেন ‘বোবা’, সেটিও আন্দাজ করা কঠিন নয়। এ ভুত মানুষকে বোবা বানিয়ে দেয়, তাই এর নাম ‘বোবা’। যাই হোক, ‘বোবা ধরা’ পরিভাষাটি কোনো বৈজ্ঞানিক পরিভাষা নয়, বহুল প্রচলিত একটি বাগধারা মাত্র। বোবা ধরার বাংলা পরিভাষা হলো ‘নিদ্রা পক্ষাঘাত’, ইংরেজিতে ‘Sleep/Sleeping Paralysis’। যেহেতু বোবায় ধরলে কোনো ব্যক্তি তাৎক্ষণিকভাবে অতি-অল্প সময়ের জন্য বাক ও চলনশক্তি হারিয়ে ফেলেন, তাই এটিকে ঘুমের পক্ষাঘাত বা প্যারালাইসিস বলা হয়।


যখন বোবায় ধরে, তখন কী হয়?

পেনিসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ব্রায়ান শার্পের মতে, বোবায় ধরা বা স্লিপ প্যারালাইসিস হলে, তিন ধরনের দৃষ্টিভ্রম বা হ্যাল্যুসিনেশন তৈরি হতে পারে। প্রথমটি হলো ইনট্রুডো বা ঘরের ভেতর কোনো অতিপ্রাকৃত (বিজ্ঞান অথবা প্রকৃতির নিয়মের দ্বারা যার ব্যাখ্যা সম্ভব না) কিছুর উপস্থিতি টের পাওয়া। দ্বিতীয়টি হলো ইনকিউবিস, কারো মনে হতে পারে যে, কোনো দৃশ্যমান বা ঈষৎ-অদৃশ্য সত্তা তার বুকের ওপর চেপে বসে আছে। সর্বশেষ হলো লেভিটেশন, এমন মনে হতে পারে, কেউ শোয়া অবস্থাতেই শূন্যে তুলে ফেলেছে এবং তাকে কোনো অচেনা গন্তব্যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।


এ তিন অবস্থার ভেতর একটি সাধারণ পরিস্থিতি সবাই অনুভব করে, আর তা হলো, কথা বলতে না পারা এবং নড়াচড়া করতে না পারা। চিৎকার করতে চাইলেও মুখ ফুটে কোনো শব্দ বের হবে না। হাত-পা ছুঁড়তে চাইলেও ছোড়া যাবে না, মনে হবে কেউ দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছে। এ পক্ষাঘাত বা প্যারালাইসিস দশা স্থায়ী হবে সর্বোচ্চ কয়েক সেকেন্ড। এই পক্ষাঘাত অবস্থায় হ্যাল্যুসিনেশন তৈরি হয়, ফলে চোখের সামনের স্বাভাবিক কোনো কিছুকেও ভুত-প্রেত বলে মনে হয়।


পৃথিবীর প্রায় সব লোকগাঁথাতেই ভূত একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। রাতের বেলায় অশরীরীরা নানা বেশে এসে মানুষকে ভয় দেখায়, এমন কথা সব জায়গাতেই প্রচলিত। এই ভয়ের অনুভূতির সাথে বোবায় ধরা বা স্লিপ প্যারালাইসিস জড়িয়ে গেছে আষ্টেপৃষ্ট। আর কোনো ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা জানবার আগে তার পেছনে অলৌকিকতা খোঁজা হতো। এ কারণেই বোবায় ধরাকে অনেকেই শয়তান বা ভূতের উপস্থিতি বলে মনে করেন।


বোবায় ধরার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা:

নিদ্রা বিশেষজ্ঞদের মতে, বোবায় ধরা তেমন কোনো গুরুতর রোগ বা অস্বাভাবিকতা নয়। তাই ঐ অর্থে তারা, এটি কোনো রোগ বা রোগের আলামতও বলতে চান না। তাদের মতে, বোবায় ধরা হলো একটি অন্তর্বর্তীকালীন অবস্থা, যেখানে আমরা ঘুম ও জাগরণের একটি মাঝামাঝি দশায় অবস্থান করি। ঘুমোনোর সময় আমাদের মস্তিষ্ক কথা বলা সহ চলনক্ষমতা বন্ধ রাখে, যাতে আমরা ঘুমের মাঝে চলতে গিয়ে হটাৎ আঘাত না পাই। কিন্তু আসার কিছুক্ষণের মাঝেই অনেক সময় আমরা জেগে উঠি। অর্থাৎ কখনো কখনো মস্তিষ্কের চেতন অংশের পুরোটা একসাথে কার্যকর হয় না। তখন অন্য অনুভবশক্তি যেমন: দৃষ্টিশক্তি সচল থাকলেও চলন ও বাকশক্তি ফিরতে একটু সময় নেয়। ফলে, এর মাঝেই তৈরি হয় সাময়িক পক্ষাঘাত বা বোবায় ধরা।


ঘুম ও জাগরণের মধ্যবর্তী এ অবস্থার প্রকরণ হলো দুটি। একটি হতে পারে, যখন কেউ জাগ্রত অবস্থা থেকে ঘুমাচ্ছে বা ঘুমাবো ঘুমাবো করছে। অন্যটি হতে পারে যখন ঘুমন্ত অবস্থা থেকে জেগে উঠেছে বা উঠবে। প্রথমটিকে বলা হয় প্রিডরমিটাল স্লিপ প্যারালাইসিস (Predormital  Sleep Paralysis) এবং দ্বিতীয়টিকে পোস্টডরমিটাল স্লিপ প্যারালাইসিস (Postdormital Sleep Saralysis)।


প্রিডরমিটাল স্লিপ প্যারালাইসিস (Predormital Sleep Paralysis):

যখন কেউ ঘুমাতে যায় তখন অনুভূতিগুলো হালকা হয়ে আসতে থাকে। সে অবস্থায় কেউ শরীরের ঘটমান ও আসন্ন পরিবর্তনগুলো টের পায় না বা অচেতন হয়ে থাকেন। কিন্তু কোনোভাবে যদি কেউ চেতনা ফিরে পান, তবে তিনি দেখতে পাবেন যে তিনি কথা বলতে বা নড়তে পারছেন না।


পোস্টডরমিটাল স্লিপ প্যারালাইসিস (Postdormital Sleep Paralysis):

ঘুমের, REM (Rapid Eye Movement) ও NREM (Non-Rapid Eye Movement) নামে দুটো পরিভাষা রয়েছে। ৩টি NREM ও একটি REM দ্বারা ৯০ মিনিট ব্যাপী ঘুমের একটা চক্র আবর্তিত হয়। NREM সবার আগে সংঘটিত  হয় এবং তা দ্বারা অতিক্রান্ত সময় মোট নিদ্রিত অবস্থার ৭৫ ভাগ। এ সময় শরীর নিজেকে পুরোপুরি ভাবে ছেড়ে দেয় এবং  দেহজ ক্ষয়পূরণ করে।


দ্বিতীয় ভাগ অর্থাৎ REM অবস্থায় চোখের বিক্ষিপ্ত পরিচলন শুরু হয় এবং এসময় মানুষ স্বপ্ন দেখতে থাকে। এ সময়ে চোখ ব্যতীত পুরো দেহ স্থিতাবস্থায় থাকে, পেশীগুলোর কার্যকারিতাও বন্ধ থাকে। এই REM চক্র শেষ হবার আগেই যদি কেউ জেগে যায় তখন সে আবিষ্কার করে যে, সে কথা বলতে বা নড়তে পারছে না।


বোবায় ধরার কারণসমূহ:

মায়ো ক্লিনিকের গবেষণা অনুযায়ী, ১০-২৫ বছর বয়সীদের ভেতর এ সমস্যা টি বেশি দেখা যায়। নিউ ইয়র্কের মন্টেফিওর হেলথ সিস্টেমের স্লিপ -ওয়েক ডিজঅর্ডার সেন্টারের চিকিৎসক ডা. শেলবি হ্যারিস উল্লেখ করেছেন যারা স্লিপ অ্যাপ্নি কিংবা নার্কোলেপ্সি ধরনের নিদ্রাজনিত রোগে আক্রান্ত, তাদের বেলায় বোবায় ধরার হার বেশি।


যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্যানিয়েল ডেনিস ৮৬২ জন ভাই-বোনের মধ্যে চালানো গবেষণার মাধ্যমে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, বোবায় ধরা বা স্লিপ প্যারালাইসিসে বংশগতি বা জিনগত কারণ রয়েছে। ২০১১ সালে পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির চালানো এক গবেষণায় দেখা যায়, বিশ্বের প্রায় ৭.৬ ভাগ মানুষ এ সমস্যায় ভোগেন। বিষণ্ণতা বা উদ্বিগ্নতায় আক্রান্ত রোগীদের শতকরা প্রায় ৩২ ভাগের ভেতরেই বোবায় ধরা বা স্লিপ প্যারালাইসিসের সমস্যাটি দেখা যায়। এর বাইরে সাধারণভাবে যেসব কারণে বোবায় ধরে সেগুলো হলোঃ-

  • কম ঘুমানো
  • ঘুমের সময় পরিবর্তন হওয়া
  • উপুড় হয়ে ঘুমানো
  • মাদকাসক্তি
  • বাইপোলার ডিজঅর্ডার বা এ জাতীয় মানসিক সমস্যা থাকা
  • অতি ঘুমকাতরতা বা নার্কোলেন্সি, ঘুমের মধ্যে হাত-পা ছোঁড়া বা হাঁটা সহ অন্যান্য নিদ্রাজনিত রোগ থাকা
  • সক্রিয়তা বর্ধক ঔষধ ব্যবহার


বোবায় ধরার সমস্যা থেকে বাঁচতে করণীয়:

আগেও উল্লেখ করা হয়েছে, বোবায় ধরা আসলে গুরুতর কোনো রোগ বা এমন কিছুই নয়। তাই এর জন্য কোনো চিকিৎসারও প্রয়োজন নেই। তবে এটি যদি খুবই বেশি হয় অর্থাৎ ঘুমে নিয়মিতভাবে ব্যাঘাত ঘটায় বা উদ্বিগ্নতার কারণে রক্তচাপ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে বা কমে যায়, তখন এই বোবায় ধরা থেকে বের হবার কিছু নিয়ম অনুসরণ করতে হবে।


প্রথমত, একজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের কাছে কাছে যেতে হবে। তিনি মেডিকেল রেকর্ড ঘেঁটে অন্য কোনো নিদ্রাজনিত রোগ আছে কিনা দেখবেন। এরপর প্রয়োজন হলে তিনি ঘুম বিশেষজ্ঞের কাছে সুপারিশ করতে পারেন। তবে যে কাজগুলো নিজেকে করতে হবে, তা হলো-

  • নিয়মিত কমপক্ষে ৬-৮ ঘন্টা ঘুমাতে হবে
  • ঘুমানোর পদ্ধতি পাল্টাতে হিবে। বিশেষত উপুড় হয়ে কখনোই ঘুমানো যাবে না
  • ঘুমের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ মোতাবেক এন্টি-ডিপ্রেসেন্ট বড়ি সেবন করা পারে
  • অন্যান্য নিদ্রাজনিত বা মানসিক সমস্যা থেকে থাকলে সেগুলোর চিকিৎসা নিতে হবে


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন